দেবিদ্বারে গ্রেফতার আতঙ্কে ১০ গ্রামের মানুষ নেপথ্যের ইন্ধনদাতাদের খুঁজে বের করার দাবি

- আপডেট সময় : ১১:২১:২৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৯ মার্চ ২০২৩ ৩২ বার পড়া হয়েছে
|| এস এম মাসুদ রানা ||
কুমিল্লার দেবিদ্বারে উপজেলার মাশিকাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ছাত্রী শ্লীলতাহানির অভিযোগে ‘দিনভর অবরুদ্ধ’ থাকা এক প্রধান শিক্ষককে উদ্ধার করতে গিয়ে পুলিশ-জনতার সংঘর্ষের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার আতঙ্কে বাড়ি ছাড়া ১০ গ্রামের পুরুষরা। গ্রেফতার এড়াতে বাড়ি-ঘর ছেড়ে অন্যত্র থাকছেন তাঁরা। নারীরা রয়েছেন উৎকণ্ঠায়। শনিবার বিকালে মাশিকাড়াসহ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র।
সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় এলাকার নারীদের সাথে। তারা বলেছেন, পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা অত্যন্ত নিন্দনীয়। আমরা তদন্তপূর্বক সঠিক বিচার দাবি করছি, যারা এ ঘটনার নেপথ্যে কাজ করছে তাদেরকেও খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া হোক। পাশাপাশি কোন নিরাপরাধ মানুষ যাতে হয়রানি বা গ্রেফতারের শিকার না হয় সেটিরও অনুরোধ জানাচ্ছি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন বয়স্ক বলেন, এ ঘটনায় বাহিরের কেউ না কেউ ইন্ধন দিয়ে থাকতে পারে। প্রধান শিক্ষক স্থানীয় এমপি’র সমর্থক হওয়ায় তার উপর অন্য একাধিক গ্রুপ ক্ষুব্ধ ছিল। যা ঘটনার দিন রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় রুপ নেয়। অগ্নিসংযোগ, পুলিশের ওপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুর, পুলিশ সদস্যদের অবরুদ্ধ করে রাখা, অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া এগুলো বিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাজ হতে পারে না। ভিডিওতে দেখেছি অনেক বহিরাগত রয়েছে, ছবি দেখে তাদের গ্রেফতার করা হলে সংঘাতের মূল রহস্য বের হবে। যারা সংঘর্ষের নেপথ্যে ইন্ধন দিয়েছে তাদের খুঁজে বের করার জোর দাবি জানাচ্ছি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাশিকাড়া, রামপুর, পদ্মকোট, গণেশপুর, শাকতলা উত্তর পোনরা, দক্ষিণ পোনরা, ভূষনা, বারেরা গ্রামের এক অংশ ও ধামতির গ্রামের এক অংশসহ এ ১০ গ্রামের পুরুষরা এখন গ্রেফতার আতঙ্কে রয়েছে। শনিবার সন্ধ্যায় মাশিকাড়া বাজারে গিয়ে দেখা গেছে পুরো বাজার পুরুষ শূন্য। দু’একটি ফার্মেসী ছাড়া দোকান-পাট বন্ধ রয়েছে।
বাজারের ফার্মেসী ব্যবসায়ী শরীফুল ইসলাম বলেন, তিন দিন ধরে দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। ভাটা পড়ছে ব্যবসা ও আয়মূলক কর্মকাণ্ডে। আতঙ্কে বাজারে কোন মানুষ উঠছে না। বাড়ি-ঘরেও মানুষ নেই। দিনের বেলায় কয়েকজন মুরুব্বিকে দেখা গেলেও ২০-৩০ বছর বয়সী কোন পুরুষ দেখা যায় না। সবাই আতঙ্কে রয়েছে। একজন নারী বলেন, দুপুরে কে বা কারা বলছে, মাশিকাড়া বাজারে পুলিশ অভিযানে আসছে, এ কথা শোনার পর বাড়ি ঘরে যারা ছিল তারা এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি করে পালিয়ে যায়। এভাবে ভয়ে থাকতে হয় সবাইকে। কে কখন গ্রেফতার হয় সে আতঙ্কে কাটছে দিন।
আরও জানা গেছে, গত বুধবার সকালে মাশিকাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ ওঠার পর ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অভিযুক্ত মোক্তল হোসেনকে তাঁর কক্ষে ‘দিনভর অবরুদ্ধ’ রেখে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী। পরে দুপুরে পুলিশের একটি দল পরিস্থিতি শান্ত করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। খবর পেয়ে দেবিদ্বার-বিপাড়া (সার্কেল) সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপার মো. আমিরুল্লা, দেবিদ্বার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কমল কৃষ্ণ ধর, পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) খাদেমুল বাহার বিন আবেদসহ পুলিশের আরও একটি টিম ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। এসময় পুলিশ হ্যান্ডমাইকে বার বার ঘোষণা দেন, ‘আপনারা শান্ত হোন’ অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে’। পুলিশের পক্ষ থেকে এমন আশ্বাস দিলেও উত্তেজিত জনতা বিক্ষোভ বন্ধ না করে চালিয়ে যাচ্ছিলো। পরে রাত ৯টার দিকে কুমিল্লা পুলিশ সুপার মো. আব্দুল মান্নান (বিপিএমবার), অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. মোশারফ হোসেন, ইউএনও ডেজী চক্রবর্তীসহ বিপুল পরিমাণ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বিদ্যালয়ের দোতলায় অবরুদ্ধ থাকা প্রধান শিক্ষক ও পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করতে গেলে উত্তেজিত জনতা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। তারা বৃষ্টির মত ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করতে পুলিশও কয়েক রাউন্ড রাবার বুলেট ও শর্টগানের গুলি ছোঁড়ে। এ ঘটনায় পুলিশের একজন গুলিবিদ্ধসহ আহত হয় ৫জন। অন্যদিকে, বিক্ষোভকারীদের মধ্যে গুলিবিদ্ধসহ গুরুতর আহত হয় অন্তত আরও ২০ জন। এ ঘটনার পরদিন বৃহস্পতিবার দুপুরে দেবিদ্বার থানার উপ-পরিদর্শক মোক্তার আহমেদ বাদি হয়ে পুলিশের কাজে বাধা, বিস্ফোরক দ্রব্য আইনসহ ১২টি ধারায় ২১০ জনের অজ্ঞাত নামে একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় এখন পর্যন্ত ১৬জনকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। অপরদিকে, শ্লীলতাহানির শিকার ভুক্তভোগী ওই ছাত্রীর বাবা বাদি হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক মো.মোক্তল হোসেনকে একমাত্র আসামি করে অপর আরেকটি মামলা দায়ের করেছেন। ওই মামলায় বর্তমানে ওই শিক্ষক জেল হাজতে রয়েছেন।
দেবিদ্বার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কমল কৃষ্ণ ধর বলেন, মাশিকাড়ার সংঘর্ষের ঘটনায় দেবিদ্বার থানায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর একটি পুলিশ বাদি হয়েছে। অপরটির বাদি হয়েছে ভুক্তভোগী ওই ছাত্রীর বাবা। এই দুই মামলায় এখন পর্যন্ত মোট ১৭জনকে গ্রেফতার করা জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।